বুয়েটকাল [কিস্তি ৫]

  • শাকুর মজিদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কিস্তি ৪. মুরগী ধরার কাল

প্রাক বুয়েটের সাংবাদিককাল

বুয়েটে ভর্তির আগে আমি ক্যামনে যেন ‘সাংবাদিক’ হয়ে গিয়েছিলাম। ১৯৮৪ সালে এইচএসসি পাশ করে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে ভর্তি হয়ে বাড়িতে বসে থাকি। কারণ এরশাদবিরোধী আন্দোলন করতে করতে এবং এই আন্দোলন যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা না করতে পারে তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখতে রাখতে তারা সেশনজটের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। তাই ১৯৮৪ সালের নভেম্বরে ভর্তি পাকা করে ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বেকার বসে থাকতে হয়েছিল গ্রামের বাড়িতে। বাড়িতে আমার সঙ্গী কিছু বই, যার প্রধান উৎস আকাদ্দস সিরাজুল ইসলামের লাইব্রেরি আর তাঁর পুত্র, আমার সহপাঠি খালেদ জাফরি।

বিজ্ঞাপন

দিনের বেলা বেশিরভাগ সময় কাটে তাদের বাড়িতে। অনেকদিন দুপুরে খাইও। মাঝে মাঝে তাঁদের বাড়ি গিয়ে শুনি, বাপ-বেটা বিয়ানীবাজার গেছেন। খালেদ তখন সাংবাদিক। ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলার বাণী দৈনিকের বিয়ানীবাজার প্রতিনিধি সে।

এক সময় তার সঙ্গ নিয়ে আমিও বিয়ানীবাজার যাওয়া শুরু করি। সেখানে দেখা হয় নানা সাংবাদিকের সাথে। তারা সবাই জোটবেঁধে নিউজ পাঠান সিলেটের নানা সাপ্তাহিকে। পোস্টাফিসের নিচে নিউজ পেপার এজেন্সি। এখানে সবাই নিজেদের কাগজ খোঁজেন, নিউজ এলে দেখান। না এলে রাগ ঝাড়েন।

এই করতে করতে আমার কতগুলো পত্রিকার সাথে পরিচয় হয়। সব সাপ্তাহিক। নামগুলো ছিল এমন যে, যুগভেরী, দেশবার্তা, সিলেট বাণী, সিলেট সমাচার, জালালাবাদ এমন। এর প্রায় প্রত্যেকটি ডাকে আসত খালেদের বাড়ি। আমি সেখানেই পড়তাম।

একদিন দেখি লন্ডন থেকে একটা বাংলা পত্রিকা এসেছে। অফসেট কাগজে ছাপা, ট্যাবলয়েড আকার। খুব সুন্দর সুন্দর ছবি। নাম—সাপ্তাহিক প্রকাশ।

আমি ঠিকানা নিয়ে একটা কবিতা পাঠিয়ে দিলাম পত্রিকার সম্পাদককে চিঠি দিয়ে। মাস খানেক পর আমার ঠিকানায়ও সেই পত্রিকার প্যাকেট এলো লন্ডন থেকে। পত্রিকার সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক। তিনি একটা চিঠিও লিখলেন আমাকে। বিয়ানীবাজার থেকে তার পত্রিকায় নিউজ বা লেখা পাঠাতে। আর আমার ছবি ও বায়োডাটা যেন দেই, তিনি আমার জন্য পরিচয়পত্র পাঠাবেন।

আমি ভাবলাম, যে ঘটনা আজ ঘটল তা লিখে ডাকযোগে তার কাছে পৌঁছাতে ৮-১০ দিন লাগবে। তখন এই ঘটনা পুরানা হয়ে যাবে। তারচেয়ে আমার যা মনে আসে তাই লিখি।

আমি ‘বিয়ানীবাজারের চিঠি’ নাম দিয়ে লেখা পাঠাই। এর ২-৩ সপ্তাহ পর আবার বড় খাম আসে। ভেতরে আমার লেখা—বাংলাদেশের ছাত্ররা কেন ফ্রাস্টেশনে ভুগছে, লেখক—শাকুর। লেখার সাথে আমি নিজে একটা ছবি এঁকে ইলাস্ট্রেট করে দিয়েছিলাম, সেই ছবিও।

এই পত্রিকার সাথে আসে চিঠি। বলা হয় নিয়মিত একটা কলাম লিখতে। আমি বিয়ানীবাজারের চিঠি নাম দিয়ে লেখা শুরু করি। ১৯৮৪ সালের আগস্ট মাস থেকে প্রকাশ-এ আমার লেখা প্রকাশ হতে থাকে। দুই তিন সংখ্যা পর দেখি আমার লেখার সাথে একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবিও দেওয়া হচ্ছে। এই পত্রিকা খুব বেশিদিন নিয়মিত হয়নি। এক সময় বন্ধ হয়ে যায়।

বিয়ানীবাজারের সাংবাদিক মহলে এই পত্রিকা নিয়ে নানা আলোচনা হয়। এই পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হচ্ছে, এটা বিয়ানীবাজারের বড় বড় সাংবাদিকদের নজরে আসে। মাঝে মাঝে আমি খালেদের সঙ্গে বিয়ানীবাজারের বকুলের হোটেলে তাদের সাথে আড্ডায় বসি। সবাই কথা বলে, আমি শ্রোতা।

একদিন শুনি—আব্দুর রউফ খান মিস্টু খালেদকে বলছেন, একটা ছেলে দিতে। সমাচারের (সাপ্তাহিক সমাচার) জন্য। তিনি এই পত্রিকার বিয়ানীবাজার প্রতিনিধি আছেন। কিন্তু তাঁর আমেরিকা যাবার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। যে কোনো সময় তিনি উড়ে যাবেন। এই পোস্টে একজন বিয়ানীবাজার প্রতিনিধি দরকার। এই পত্রিকাটা আগামীতে দৈনিক হয়ে যাবে। আমার ইচ্ছা হয়, আমি বলি, আমাকে যেন বিয়ানীবাজার প্রতিনিধি করা হয়। কিন্তু বলতে পারি না, লজ্জা লাগে।

এর দুই তিনদিন পর গ্রামের পোস্টাফিসে যাই কোনো এক লিটিলম্যাগ সম্পাদকের কাছে আমার হাতে লেখা গল্প পাঠাতে। পোস্ট মাস্টার মতিউর রহমান। তিনি হাতে নিয়ে ওজন করে বলেন ৬ টাকা দিয়ে দিতে। আমি বলি, বুক পোস্টে পাঠাব, খোলা ডাক, খাম বন্ধ নাই, এর রেইট আরো কম হবে, আমাকে রেইট চার্ট দেখান।
তিনি একটা বই বের করে আমাকে দেখান। সেখানে গ্রাম হিসাবে ডাক মাসুল লেখা।
আমি বলি, আমাকে দেখান এটা কত গ্রাম।
তিনি একটা পাললা নিয়ে আসেন। এক পাললায় আমার লেখা ১০ পাতার পাণ্ডুলিপিভরা খাম, আরেক পাললায় কতগুলো নানা আকারের ছোট ছোট পাথর। এগুলো কংক্রিটের ঢালাই কাজে ব্যবহার হয়। পথে ঘাটে পাওয়া যায়।
আমি ভেজাল শুরু করি।
এই পাথর যে এত গ্রামের সমান তার কী প্রমাণ?
তিনি প্রমাণ দেখাতে পারেন না। আমাকে বলেন, ঠিক আছে ৫ টাকা দেন।
আমি বলি, না, এটা ৪ টাকার বেশি হবে না।
তিনি ৫ টাকায় থাকেন। আমি ৫ টাকা দিয়ে খোলা ডাকে লেখা ছাড়ি।
বাড়ি গিয়ে আমি একটা নিউজ তৈরি করলাম—মাথিউরা ডাকঘরে নুড়ি পাথর দিয়ে ওজন মাপা হয়।

এই শিরোনামে নিউজ ও তার সাথে বিয়ানীবাজার প্রতিনিধি হবার আবেদন শীর্ষক আরেকটা চিঠি লিখে খামবন্দি করে পরদিন সেই পোস্টাফিসের ডাকবাক্সে নিজ হাতে খাম ঢুকিয়ে চলে আসি। পরের সপ্তাহে বিয়ানীবাজার গিয়ে সিলেট সমাচার খুঁজি এবং পেয়েও যাই। দেখি এই সংবাদটি দ্বিতীয় পাতায় ছাপা হয়েছে বিয়ানীবাজার সংবাদদাতার ক্রেডিট লাইনে।

আমি কাউকে কিছু বলি না।

এর কয়েকদিন পর সিলেট এসে সমাচার-এর অফিসে যাই সম্পাদকের সাথে দেখা করব বলে। অফিস খুজে পাই, কিন্তু সম্পাদক পাই না। অফিসে দেখি খুব সুন্দর এক তরুণী বসে আছেন। তিনি এই অফিসে কাজ করেন। আমার নাম বলতেই আমাকে চিনে ফেললেন, কারণ তিনিও লিটিল ম্যাগাজিনে লেখেন। তিনি লিখেন ছড়া । নাম রোকেয়া খাতুন রুবী। পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আমাকে বলেন এই পত্রিকায় ছড়া-কবিতা লিখতে।

আমি এই পত্রিকাই শুধু না, অনেক পত্রিকায় লিখতে শুরু করি। প্রতি সপ্তাহে ৪/৫টা লেখা হয়ে যাচ্ছে, এক পত্রিকায় সব ছাপবে না। আমি পত্রিকা যোগাড় করে ঠিকানাটা টুকে রাখি। তারপর খোলা ডাকে ২/৩ টাকার মধ্যে লেখা পাঠাই।

১৯৮৫ সালের নভেম্বর মাসের একটা ঘটনা আমার মোড় পালটে দিলো।

একদিন সকালবেলা হন্তদন্ত হয়ে খালেদ এলো বাড়িতে। এক্ষুনি বিয়ানীবাজার যেতে হবে। গত পরশুদিন শেওলা ফেরিঘাটে একটা বাস উপরে উঠতে গিয়ে ব্রেক ফেল করে নদীতে পড়ে যায়। তিরিশজনের মতো লোক মারা গেছে। এটা নিয়ে সে বাংলার বাণীতে নিউজ পাঠাবে। তার ছবি দরকার।

আমার একটা ইয়াসিকা অটো ফোকাস ক্যামেরা আছে, কিন্তু ফিল্ম নাই। এটা নিয়ে রওয়ানা হলাম বিয়ানীবাজার। প্রথমে ফিল্ম কিনতে হবে। সাদা কালো ফিল্ম আলাদা পাওয়া যাবে না। এক স্টুডিও’র সাথে কথা হলো। তিনি তার ক্যামেরা থেকে ফিল্ম বের করে কেটে আমার ক্যামেরায় ভরে দিলেন।

আমরা বাস, রিকশা, ভ্যানগাড়ি করে স্পটে গিয়ে দুই তিনটা পরিবারের সাথে দেখা করি। লাশ ততদিনে কবর দেওয়া হয়ে গেছে। ঘাটে ফেরি চলাচল বন্ধ। আমরা বিয়ানীবাজার ফেরত আসি। প্রথমে ফটো স্টুডিওতে ক্যামেরা দিয়ে চলে যাই নিউ মার্কেটে টেলিগ্রাফ অফিসে। সেখানে বসে বসে খালেদ নিউজ লিখে বাংলায়। আমি অনুবাদ করি ইংরেজিতে। তারপর শুরু হয় টরে টক্কা, হ্যালো, ঢাকা, আলফা, বিটা, চার্লি, ডেল্টার কথামালা। প্রায় দুই ঘণ্টায় খালেদ নিউজটি বাংলার বাণীতে পাঠাল।

এবার ছবি সংগ্রহের পালা। স্টুডিওতে গিয়ে শুনি একটা ছবিও ওঠেনি। ফিল্ম লোড হয়নি। এবার একজন আরেকজনকে দোষারোপ করার পালা।

খালেদের মন খারাপ। কারণ সে এই নিয়ে একটা সচিত্র ফিচার লিখতে পারল না বাংলার বাণীর জন্য। কিন্তু আমার মনে হলো অন্য কথা। শেওলার ফেরি ঘাটের এমন দুর্ঘটনা হতো না, যদি এখানে একটা ব্রিজ হয়ে যেত। আমি সারারাত জেগে একটা লেখা তৈরি করে ফেললাম। শিরোনাম দিলাম—আলাদিনের আশ্চর্য্য প্রদীপ নয়, দরকার বড় সাহেবের নেক নজর।

লিখে ডাকে পাঠিয়ে দেই সাপ্তাহিক যুগভেরিতে।

এর কিছুদিন পরই আমি ঢাকা চলে আসি। সিলেটের পত্রিকার বিয়ানীবাজার প্রতিনিধির কাজ করা আমার হয় না যদিও, কিন্তু এই রিপোর্টটি আমার আরেক জানালা খুলে দেয়।

১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি ঢাকা এসে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে আপাতত উঠেছি। মাস দুই পরে নিজের হলে যাব। এমন সময় একটা চিঠি আসে লন্ডন থেকে। আমার কুসুম খালা এক চিঠিতে একথা সেকথার ফাঁকে লেখেন—সুরমা পত্রিকায় শেওলার এক্সিডেন্ট নিয়ে আমার লেখা পড়ে খুব খুশি হয়েছেন।

আমি বিষয়টি ধরতে পারি না। লন্ডনের নাম করা পত্রিকা সুরমা। কিন্তু আমি তো সেখানে কোনো লেখা পাঠাইনি। আমি জবাবে লিখি, আমাকে তাড়াতাড়ি সেই পত্রিকাটা পাঠাও। দুই সপ্তাহের মধ্যে আমার কাছে একটা বড় খাম আসে। ভেতরে লন্ডন থেকে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক সুরমা। আমি খাম খুলে দেখি, কিছুদিন আগে সাপ্তাহিক যুগভেরিতে যে লেখাটা বেরিয়েছিল, হুবহু সেই লেখা, সেই শিরোনাম। আমার নামটাও বড় করে লেখা।

লন্ডনের পত্রিকায় আমার নাম দেখে আমি অভিভূত। চিঠি লিখি পত্রিকার সম্পাদক আয়শা আহমেদের নামে। জবাব দেন ডা. ফজল মাহমুদ। তিনি ওখানে এই পত্রিকাটা চালান। আমাকে বলেন, ঢাকার কিছু সংবাদ পাঠানোর জন্য। আমি আমাদের মিছিল মিটিং, বোমাবাজি, ব্যারিকেড, এসবের ছবি তুলে পাঠাই ডাকযোগে। ২/৩ সপ্তাহ পর আমার কাছে বড় প্যাকেটে পুরো সুরমা পত্রিকা আসে। দেখি আমার নাম ছাপা হয়, শাকুর মজিদ, ঢাকা প্রতিনিধি ।

সেখান থেকে শুরু হয় আরেক অধ্যায়।

(চলবে)